টার্গেট বিলাসবহুল গাড়ি

স্টাফ রিপোর্টারঃ
২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল। হাতিরঝিল
এলাকা থেকে পাওয়া গেল একটি
বিলাসবহুল গাড়ি। প্রায় চার কোটি টাকা
দামের পোরশে কায়ানে ৯৫৫ মডেলের
গাড়ির সঙ্গে একটি আবেগময় চিঠিও
উদ্ধার হলো। চিঠিতে গাড়ির মালিক
লিখেছেন, ‘আমি বিগত কয়েক বছর থেকে
গাড়িটি ব্যবহার করছি। গাড়িটি আমার
অনেক প্রিয় ও আবেগের। সম্প্রতি আমি
জানতে পারি এই গাড়িটিতে ট্যাক্স
ফাঁকি দেয়া হয়েছে। আমি সমাজের
সম্মানী ব্যক্তি। আমাকে অনেকে এক
নামে চেনে। মানসম্মানের কথা ভেবে
আমি নিজের ইচ্ছায় গাড়িটি ফেলে
রেখে গেলাম। দয়া করে আমাকে
খোঁজার চেষ্টা করবেন না। ট্যাক্স ফাঁকি
দিয়ে অন্যায় করলেও এটি জমা দিয়ে
আমি প্রায়শ্চিত্ত করলাম।’
কারনেট সুবিধার মাধ্যমে লন্ডন প্রবাসী
এক নারী চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ২০১০ সালে
পোরশে মডেলের গাড়িটি ঢাকায়
এনেছিলেন। গাড়িটির রেজিস্ট্রেশন করা
ছিল না। চিরকূট লিখে নিজের
প্রায়শ্চিত্তের কথা বলে লন্ডনে পাড়ি
জমান গাড়ির মালিক।
তার মতো বিত্তশালী আরো কয়েকজনের
তালিকা তৈরি করেছে সংশ্লিষ্ট
কর্তৃপক্ষ। এ জন্য রাতের ঢাকায় কাজ
করছে দক্ষ অনুসন্ধানী টিম। গুলশান-বনানী,
বারিধারা, ধানমণ্ডি, উত্তরা ছাড়াও
সিলেট এবং চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায়
অনুসন্ধানী টিমের কাছে রুই কাতলাদের
ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া গাড়ির প্রাথমিক তথ্য
মিলেছে। অবাক হওয়ার মতো তথ্য যে,
কয়েকজনের আয়-ব্যয়ের সঙ্গতির চেয়ে
গাড়ির বাহাদুরি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এসব
ব্যক্তির অর্থের যোগান কোথা থেকে
আসে সে বিষয়েও অনুসন্ধান করছেন
গোয়েন্দারা। সময় হলে এদের মুখোশ
উম্মোচন করা হবে।
দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, কর
ফাঁকি দিয়ে যারা গোপনে বিলাসবহুল
গাড়ি ব্যবহার করছেন তাদের জন্য আসছে
আরো কঠোর বার্তা। বেশ কিছু বিলাসবহুল
গড়ি এরআগে উদ্ধারও হয়েছে। তবে নতুন
তালিকায় আরো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক
গাড়ি আছে। এসব গাড়ি ও মালিকের
বিষয়ে প্রাপ্ত প্রাথমিক তথ্য যাচাই
বাছাই শেষে অভিযান শুরু হবে।
শুল্ক গোয়েন্দা সূত্রে আরো জানা গেছে,
২০১৫ সাল থেকে ২০১৮ সালের চলতি মাস
পর্যন্ত দেশি বিদেশি অসংখ্য ব্যক্তির
গাড়ি জব্দ করা হয়েছিল। শুল্ক ও কর ফাঁকি
দিয়ে দেশে আনা হয়েছিল এসব গাড়ি।
কয়েকটি গাড়ি বিদেশি শুল্কমুক্ত সুবিধায়
আনলেও পরে তা ফেরত নেয়নি। তালিকায়
রয়েছে ধনকুবের মুসা বিন শমসরের রেঞ্জ
রোভার জিপ। উত্তর কোরিয়ার কূটনীতিক
হ্যান সন ইকের ঘোস্ট মডেলের রোলস
রয়েস, মিসরের কূটনৈতিক মাহমুদ ইজ্জতের
রেঞ্জ রোভার, বনানীর রেইনট্রিতে দুই
তরুণী ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি
সাফাত আহমেদের বিএমডব্লিউ।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি মিজ মির্ভা
তুলিয়ার টয়োটা রেভ-৪ ও মৃদুলা সিংহের
টয়োটা প্রিমিও, আইএলওর কর্মকর্তা
ফ্রান্সিস দিলীপের টয়োটা সিডান,
ইউএনডিপির স্টিফেন প্রিজনারের
মিতসুবিশি, সন্তোস প্রতাপের
বিএমডব্লিউ ও জুনিয়র প্রফেশনাল মিজ
নিস জ্যানসেনের পাজেরো জিপ।
ঢাকা কিংবা সিলেটে হয়তো লন্ডনের
তুর্কি বিন আবদুল্লাহর মতো সোনায়
মোড়ানো গাড়ি পাওয়া না গেলেও
কোটি কোটি টাকা মূল্যের গাড়ি লুকিয়ে
রাখা আছে কোথাও কোথাও। এ ধরনের
গোপন জায়গা শনাক্ত করা হচ্ছে। কিছু
তথ্য পাওয়া গেছে, যা অভিযানের
স্বার্থে এখনই বলা ঠিক হবে না বলে
জানান অপর এক কর্মকর্তা।
আবদুল্লাহর মতো রহস্য যুবক ঢাকাতেও
আছেন। সেই যুবকের গাড়ি আছে একাধিক।
থাকেন অভিজাত পাড়ায়। চলা ফেরা
বেশিরভাগ সময় রাতের ঢাকায়। নিজে দশ
টাকা আয় না করলেও সেই যুবক হাকিয়ে
বেড়ান দামি বাহারি গাড়ি। অভিযানের
তালিকায় রয়েছে এই যুবকের বিলাসবহুল
গাড়িটিও। একবার তাকে শনাক্ত করতে
অনুসন্ধানী টিম কাজ করলেও তিনি
গাড়িসহ আত্মগোপন করতে সক্ষম হন।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে লন্ডনে এক তুর্কি
বিন আবদুল্লাহকে ঘিরে রহস্য সৃষ্টি
হয়েছিল! পুরো লন্ডন জুড়ে আলোচনায় ছিল
মাত্র ২৩ বছর বয়সী সৌদি যুবক তুর্কির ৫টি
দামি গাড়ি। যা ছিল পুরোপুরি সোনার
তৈরি। ঢাকায় এমন এক যুবকের খোঁজ
করছেন গোয়েন্দারা, যার গাড়ি সংখ্যা
একাধিক। নিজেকে তিনি প্রিন্স বলে
জাহির করেন। তাকে ঘিরেও হয়তো
খানিকটা রহস্য তৈরি হতে পারে।
শুল্ক গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, চলতি
বছরের জুলাই মাসে রাজধানীর গুলশান
এলাকায় অভিযান চালিয়ে টয়োটা ল্যান্ড
ক্রুজার ভি-৮ এর ২০১৩ মডেলের ৪৬০৮
সিসির একটি গাড়ি উদ্ধার করা হয়। মার্চ
মাসে আরো ১২টি দামি গাড়ি উদ্ধার
করেন শুল্ক গোয়েন্দারা। জুলাই মাসে
সাভারে অবস্থিত পক্ষাঘাতগ্রস্তদের
পুনর্বাসন কেন্দ্র সিআরপি থেকে জব্দ
করা হয় আরো ১১টি বিলাসবহুল গাড়ি।
জুলাই মাস থেকে এ পর্যন্ত অভিযানে
৮০টিরও বেশি বিলাসবহুল গাড়ি উদ্ধার
হলেও এর নেপথ্যে জড়িতদের চিহ্নিত করা
হয়নি। দায়িত্বশীল এক গোয়েন্দা
কর্মকর্তা অবশ্য বলছেন, এবার কারো ছাড়
নেই। যেই হোক না কেন তাকে খুঁজে
আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি বলেন,
আগের অভিযানে বিদেশি কূটনীতিকের
গাড়িও জব্দ করা হয়েছিল। নতুন করে এমন
দু’একজনের তথ্যও অধিদফতর খতিয়ে
দেখছে।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের
মহাপরিচালক ড. সহিদুল ইসলাম বলেন,
যেখানেই শুল্ক ফাঁকির অভিযোগ
সেখানেই অভিযান চালানো হবে। এ
ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে কারো ছাড়
নেই। আগামীতে আরো জোরালো
অভিযান চালানো হবে।