সালেহ আহমদ (স’লিপক):
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মণিপুরী পাড়ায় পাড়ায় মহারাসলীলা উদযাপনের প্রস্তুতি চলছে। পাড়াগুলোর বাতাসে প্রতিদিন বিকেল থেকেই মৃদঙ্গের তালে তালে মণিপুরী গান ভেসে বেড়ায়। গান আর মৃদঙ্গের তাল অনুসরণ করে একটু এগিয়ে গেলেই চোখে পড়ে মণিপুরীদের নাচের প্রস্তুতি। মণিপুরী অধ্যুষিত গ্রাম ও পাড়াগুলোতে বইছে উৎসবের হাওয়া। চলছে গোষ্ঠলীলা বা রাখাল নৃত্য এবং রাসনৃত্যের মহড়া। অন্যান্য বছরের মতো এবারও মণিপুরীদের বসবাসরত পৃথক দু’টি গ্রামে আয়োজন করা হয়েছে মহারাসলীলা উৎসবের।
উপজেলার মাধবপুর ও আদমপুর ইউনিয়নের মণিপুরীদের বসবাসরত বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, পাড়ায় পাড়ায় চলছে রাস উৎসবের মহড়া। প্রায় ১ মাস ধরে এখানে রাস উৎসবের মহড়া চলছে। মহড়ায় আসা মণিপুরী ছেলেমেয়েদের রাসনৃত্যের বিভিন্ন কৌশল ও নিয়মকানুন শিখিয়ে দিচ্ছেন রাসনৃত্যের শিক্ষকর। সঙ্গে মৃদঙ্গ বাজিয়ে ও গান গেয়ে সেই মহড়ার তালও দেয়া হচ্ছে। রাস উৎসবে এই গান ও তালের সঙ্গেই সারারাত ধরে নাচতে হবে শিল্পীদের।
মহড়ায় অংশ নেওয়া মনিকা সিনহা বলেন, আমরা ছোটবেলা থেকেই নাচ শিখি। কিন্তু সবাই রাস উৎসবে অংশ নিতে পারে না। এ জন্য আমাদের অনেক প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এখানে প্রায় ২০ দিন ধরে বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত প্রতিদিন মহরায় অংশ নিচ্ছি। রাস উৎসব নিয়ে আমাদের ভালো প্রস্তুতি আছে। আমরা চাই আমাদের এই উৎসব দেখার জন্য সবাই আসুক।
শিক্ষক অজিত কুমার সিংহ বলেন, মূলত রাস উৎসবের প্রায় এক মাস আগ থেকেই মহড়া শুরু করি। রাস উৎসবে অংশ নেওয়া মণিপুরী ছেলেমেয়েদের অনেকেই নতুন।আবার অনেকে পুরোনো। আমরা এক মাস প্রস্তুতি নিয়ে তাদের প্রস্তুত করি। প্রতিদিন নিয়ম মেনে সবাই আসেন। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত মহড়া চলছে।
রাসনৃত্যের আরেক শিক্ষক বিধান কুমার সিংহ জানান, ১৫ নভেম্বর বেলা সাড়ে ১১টা থেকে রাখাল নৃত্য শুরু হবে। সন্ধ্যায় থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। রাত সাড়ে ১১টার দিকে শুরু হবে রাস নৃত্য। এই রাসনৃত্যের জন্যই মহড়া হচ্ছে।দেশ-বিদেশের দর্শনার্থীরা এই রাস উৎসব দেখতে এখানে ভীড় করেন। এটা মণিপুরীদের ঐহিত্যবাহী উৎসব।
মহারাসলীলা উদযাপন কমিটির সাধারন সম্পাদক শ্যাম সিংহ জানান, রাস উপলক্ষে আমাদের পাড়ায় পাড়ায় প্রস্তুতি চলছে। প্রতি বছরের মতো ঐতিহ্য ও ধর্মীয় ভাবধারায় ১৮২তম শ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলা ১৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই মহোৎসব উপলক্ষ্যে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি। রাসলীলা মণিপুরীদের আয়োজন হলেও সকলের আগমনে মানুষের মানবিক মূল্যবোধ বৃদ্ধির পাশাপাশি অপরাপর সকল জাতিগোষ্ঠীর মাঝে সম্প্রীতির বাঁধনে বেধে চলেছে এই উৎসব রাসলীলা, গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের প্রেমপ্রীতির ঐতিহ্য দর্শন।
উল্লেখ্য, কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুরের জোড়া মণ্ডপে বিষ্ণুপ্রিয়া (মণিপুরী) সম্প্রদায়ের ১৮২তম এবং আদমপুর মণিপুরী কালচারাল কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণে মৈতৈ (মণিপুরী) সম্প্রদায়ের ৩৯তম মহারাস উৎসব আগামী ১৫ নভেম্বর শুক্রবার উদযাপন হবে।
মণিপুরের রাজা ভাগ্যচন্দ্র মণিপুরে প্রথম এই রাসমেলা প্রবর্তন করেছিলেন। মণিপুরের বাইরে ১৮৪২ সালে কমলগঞ্জের মাধবপুরে প্রথম মহারাস উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। রাস উৎসবে সকালবেলা ‘গোষ্ঠলীলা’ বা ‘রাখাল নৃত্য’ হয়। গোধূলি পর্যন্ত চলে এই রাখাল নৃত্য। এরপর সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভা শেষে রাত সাড়ে ১১টা থেকে শুরু হয় রাস উৎসবের মূল পর্ব শ্রী শ্রী কৃষ্ণের মহারাসলীলা অনুসরণ। মণিপুরীদের ঐতিহ্যবাহী নৃত্যের পোশাকে নেচে গেয়ে কৃষ্ণবন্দনা ভোর পর্যন্ত চলে রাসলীলা। রাসনৃত্যে শ্রীকৃষ্ণ, রাধা ও প্রায় ৪০-৪৫ জনের মতো গোপী থাকেন।