অনেক আগে কোনো একটা নিউজ রিপোর্টে দেখেছিলাম যে, একদল বন্ধু-বান্ধব একত্রে নৌকা ভ্রমণে গিয়েছে। সেখানে বড় রকমের একটা দুর্ঘটনার পরে ঐ দলের মাত্র একজনই সুস্থভাবে ফেরত আসতে পেরেছে। তবে তা শুধুই শারীরিকভাবে, মানসিকভাবে নয়। সার্ভাইভরের মা বাবার ভাষ্যমতে, সেই মেয়েটা গত এক মাস ধরে ট্রমাটাইজড হয়ে আছে। কারো সাথে কথা বলে না, ঠিকমত খায় না, এমনকি কলেজেও যাচ্ছে না একমাস ধরে।
এটা তো গেল খুব বড় ঘটনা। কিন্তু, আমাদের জীবনে চলতে ফিরতে এমন অনেক ছোটখাটো ঘটনাও অহরহ ঘটে যাচ্ছে, যার প্রভাব আমরা সহজে কাটিয়ে উঠতে পারি না। তা হতে পারে জনসম্মুখে অপমানিত হওয়া, কোনো কাছের বন্ধুকে সারাজীবনের মত হারিয়ে ফেলা, অনেক বিশ্বাসযোগ্য কারো থেকে প্রতারিত হওয়া ইত্যাদি। এসব ঘটনা মুহুর্তের মাঝে ঘটে গেলেও এর রেশ রয়ে যায় অনেকদিন পর্যন্ত। আর, এই একটা ঘটনাই বিঘ্ন ঘটাতে থাকে আমাদের দৈনন্দিন কাজগুলোতে।
এসব ঘটনা পুরোপুরি ভুলে যাওয়া সম্ভব না হলেও, কিছু পন্থার মাধ্যমে এর থেকে কিছুটা হলেও বেরিয়ে আসা যায় আর সেই পন্থাগুলোই বলে দেবো আজ:
১। যেই জিনিস বা জায়গাগুলো সেই ঘটনাকে মনে করাচ্ছে, সেগুলো এড়িয়ে চলুন: কখনো কি এমন হয়েছে যে, আপনি কোনো একটা গান শুনে কিংবা কোনো একটা জায়গায় গিয়ে হঠাৎ করে ব্ল্যাঙ্ক হয়ে যাচ্ছেন? অথচ সেই জায়গা নিয়ে আপনার তেমন কোনো স্মৃতিই নেই? তাহলে হয়ত আপনি যখন অনেক ছোট ছিলেন, তখন সেখানে কিছু একটা হয়েছিল কিংবা সেই জায়গার কোনো একটা ব্যাপার আপনাকে অবচেতনে কোনো একটা স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছে।
আবার এমনও হতে পারে যে, জায়গাটা কিংবা জিনিসগুলোর সাথে আসলেই আপনার কোনো বাজে স্মৃতি জড়িত যা আপনি বুঝতে পারছেন। এমন হলে, ঐসব জায়গা কিংবা ঐ ধরণের জিনিসগুলো এড়িয়ে চলা উচিত। তবে যদি এই জায়গাগুলো কিংবা জিনিসগুলোর সাথে আপনি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকেন, তাহলে এগুলো না এড়িয়ে বরং আপনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখুন, যাতে এসব স্মৃতি মনে না পড়ে।
২। বাজে ঘটনাটা চিন্তা করতে থাকুন যতক্ষণ পর্যন্ত তা আপনাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে:
একটা হাসির ঘটনা যতবার মনে করবেন, তত যেমন এর হাসানোর ক্ষমতা হারিয়ে যাবে, তেমনি একটা কষ্টের ঘটনাও আপনি যতবার চিন্তা করবেন, তত কষ্ট কমে যাবে। এই কাজটা আমি মাঝেমাঝেই করি। আমার সাথে ঘটে যাওয়া যেকোনো ঘটনা নিয়ে আমি অনেক চিন্তা করতে থাকি। এভাবে সারাক্ষণ চিন্তা করতে করতে, এক সময় দেখি ব্যপারটা খুব স্বাভাবিক হতে শুরু করে এবং এক সময় গিয়ে তা আর মনে থাকে না। মানুষের একটা বড় গুণ হচ্ছে, ভুলে যাওয়ার গুণ। একটা খারাপ ঘটনা নিয়ে প্রথমবার চিন্তা করলে যেমন কষ্ট হয়, এরপর থেকে তা ক্রমশই কমতে থাকে। তবে হিতে বিপরীত হলে পন্থা পরিবর্তন করে ফেলা দরকার।
৩। স্মৃতিকে পালটে ফেলুন: একটা ব্যাপার হয়তো আপনি খেয়াল করে থাকবেন যে, আমাদের স্মৃতিগুলো কখনোই একরকম থাকে না। তা ধীরে ধীরে পরিবর্তন হয়। অনেক সময় অনেক ঘটনার অনেক জরুরি অংশ আপনি বেমালুম ভুলেও যান। এই ভুলে যাওয়াটা মূলত প্রাকৃতিকভাবে হলেও, আপনি চাইলে নিজে নিজেও তা করতে পারেন। এর জন্য আপনার স্মৃতিটাকে একটু উলটো করে নিতে হবে। ধরুন, আপনি ক্লাসে কোনো এক শিক্ষকের কাছে খুব করে তিরস্কৃত হলেন। বেঁচে থাকতেই ইচ্ছা করছে না আর। এর কারণ, শিক্ষকের কাছে তিরস্কৃত হবার দিকেই আপনার মস্তিষ্ক ফোকাস করছে। এর চেয়ে বরং চিন্তা করুন, আপনার সহপাঠী কেউ এতকিছুর পরও আপনাকে নিয়ে হাসাহাসি করেনি, কত সাপোর্টিভ তারা। কিংবা আপনার সাথে তো এর চেয়েও খারাপ কিছু হতে পারতো, কিন্তু হয়নি। চিন্তাটাকে পজিটিভ করুন। ক্লাসে একটা প্রেজেন্টেশন খারাপ হয়েছে? সবাই মজা নিচ্ছে? কিন্তু আগের দিনেরটা যে ভাল ছিলো। এছাড়াও, যখনই খারাপ কোনো স্মৃতি মনে পড়বে, তখনই সে সম্পর্কিত ভাল কিছু মনে করে ফেলুন।
৪। বর্তমানকে ভাল রাখুন: পুরোনো একটা ঘটনাকে মনে করে, বর্তমানকে খারাপ করার কোনো মানে হয়, বলুন? এর চেয়ে বরং বর্তমানটাকে ভাল করুন। বর্তমানে আপনার সাথে ঘটে যাওয়া ছোট ছোট বিষয়কে পর্যবেক্ষণ করুন। সবকিছুর ভাল দিকটা নিয়ে চিন্তা করুন। দেখবেন, অচিরেই মন ভাল হয়ে গেছে। দরকার পড়লে মেডিটেশন করুন। মনকে পরিষ্কার রাখার জন্য, নতুন করে ভাল স্মৃতি তৈরি করুন। একটা ট্যুর দিয়ে আসুন কিংবা রান্নার ক্লাস করে আসুন।
৫। বাজে ঘটনাটা আপনাকে কী শিক্ষা দিলো, তা নিয়ে চিন্তা করুন: খুব কাছের কারো থেকে প্রতারিত হয়েছেন? ভুলতেই পারছেন না? মনে করুন, মানুষটা আপনাকে মানুষ চিনতে শিখিয়েছে। কাউকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করা যে ঠিক না, তা শিখিয়েছে। ডেডলাইন ক্রস হয়ে যাওয়ায় শিক্ষক টার্ম পেপার জমা নেয় নি? এতে করে আপনি সময়ের কাজ সময় করা শিখেছেন। প্রত্যেকটা বাজে ঘটনাতেই আপনি কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু শিখেছেন।
৬। ব্যস্ত রাখুন নিজেকে: খারাপ কিছু ঘটে যাওয়ার পরপরই নিজেকে যতটা সম্ভব ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করুন। নতুন নতুন কাজ আবিষ্কার করুন। রুটিন করে ব্যায়াম করুন, বই পড়ুন, ঘর গোছান প্রতিদিন। আমার এক বান্ধবী মনকে ভাল রাখার জন্য সারাদিন অনলাইন শপিং আর হ্যান্ডিক্র্যাফট করে। এমন কিছু শখ তৈরি করুন।
৭। কষ্ট পান: আমরা অনেকেই দুঃখকে চাপা দিয়ে রাখতে চাই। ভাবি, এভাবে ভুলে যাব। এতে কিন্তু হিতে বিপরীত হয়। চোখের পানির সাথে ভেতরে চেপে থাকা অনেকটা দুঃখও কিন্তু বেরিয়ে আসে। তাই কাঁদুন, চিৎকার করুন। এতে করে নিজেকে হালকা লাগবে।
৮। শেয়ার করুন: কষ্টের কথা কাউকে বললে কষ্ট কমে। তাই কষ্ট শুধু নিজের মাঝে না রেখে বরং এ নিয়ে কারো সাথে খোলাখুলিভাবে কথা বলুন। অন্য কাউকে বলতে অস্বস্তি হলে, তা ডায়েরিতে লিখে নিজের কাছে রেখে দিন। এতে মন হালকা হবে।
বলে রাখা ভালো, আমরা অনেকেই বাজে স্মৃতিকে ভুলে থাকার জন্য অনেক বাজে পন্থা অবলম্বন করি। যেমন, সিগারেট খাওয়া কিংবা অন্য কাউকে কষ্ট দিয়ে নিজেকে হালকা করা। এসব একেবারেই উচিত না, কারণ যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে, এখন নিজের ক্ষতি করে কী লাভ? তাছাড়া অন্য কেউ কেন এর জন্য ভুক্তভোগী হবে? বরং উপরের উপায়গুলো অনুসরণ করে বাজে স্মৃতিকে ভোলার চেষ্টা করাই শ্রেয়।